কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে চাকরিপ্রত্যাশীরা বিক্ষোভের এক পর্যায়ে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। সাত ঘণ্টা পর সেই তালা খুলে দেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের লোকজন বলছেন, কে বা কারা তালা খুলে নিয়ে গেছেন। আর আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাঁরা তালা খোলেননি।
এ বিষয়ে সিভিল সার্জন শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেনের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ধরেননি। রাত আটটার দিকে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান সহকারী আমিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাড়ে সাতটার কিছু সময় আগে কেউ প্রধান ফটকের তালা খুলে নিয়ে গেছে। আমিসহ সিভিল সার্জন স্যার অফিসের ভেতরেই আছি, কাজ করছি। তবে আমি বের হয়ে যাব। সিভিল সার্জন স্যার এখানেই থাকবেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘সিভিল সার্জন স্যার যোগদানের (প্রায় আট মাস) পর থেকেই তাঁর অফিস কক্ষ লাগোয়া একটি কক্ষে থাকেন। সেখানেই রাত্রিযাপন করেন, খাওয়াদাওয়া করেন। তাঁর পরিবার খুলনায় থাকে। ছুটির দিনগুলোতে তিনি খুলনাতে চলে যান। বাকি পাঁচ দিন এখানে থাকেন।’
রাত আটটার দিকে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান ফটকে গিয়ে তালা দেখা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাত পৌনে ৯টার দিকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্যতম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাবেক সদস্যসচিব মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালা খোলা এটা জানা নেই। তালা কেউ খোলার কথা না। বিষয়টি খোজ নিচ্ছি।’ দুপুরে বিক্ষোভ আন্দোলনে অংশ নেওয়া এবং তালা লাগানোর সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন আলী মোজাহিদ নামে একজন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালা আমাদের কেউ খোলেনি। ওরাই (সিভিল সার্জন) হয়তো ভেঙেছে।’
নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে শনিবার দুপুরে কার্যালয়ের প্রধান ফটকে নতুন দুটি তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে সিভিল সার্জনসহ নিয়োগের প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিরা ভেতরে আটকে পড়েন। বিক্ষোভকারীরা বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সিভিল সার্জন ও অনিয়ম–দুর্নীতিতে জড়িত কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাকে (আরএমও) অপসারণ ও নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল না করা হবে, ততক্ষণ তালা লাগানো থাকবে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১১৫টি পদে জনবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিভিল সার্জন কার্যালয়। সে সময় ওই নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। স্বাস্থ্য সহকারী পদে ৯৭ জন, পরিসংখ্যানবিদ ৩, কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান ১, স্টোরকিপার ৪, সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর ১, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ৫ ও চালক পদে ৪ জন নিয়োগ করা হবে। এসব পদে সব মিলিয়ে আবেদন জমা পড়ে ১৬ হাজার ৭৮৯টি। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় অন্তত আট হাজারের বেশি চাকরিপ্রার্থী অংশ নেন।
অভিযোগ উঠেছে, বেশ কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী গত বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাত ও গতকাল ভোরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হোসেন ইমামের শহরের বাড়ি ও হাসপাতালের সামনে তাঁর পরিচালিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে জড়ো হন। তাঁদের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে সকালে পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এতে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করা হয়েছে। এর সঙ্গে সিভিল সার্জনসহ আরও অনেকে জড়িত রয়েছেন। শুক্রবার ভোরে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার বাড়ি ও ক্লিনিক থেকে চাকরিপ্রার্থী নারী–পুরুষদের বের হতে দেখা গেছে। এমন কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে শহরজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, গতকাল সকালে কিছু চাকরিপ্রার্থী আরএমও হোসেন ইমামের কালীশংকরপুর এলাকার বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। স্থানীয় সাংবাদিকেরা এ সময় কথা বলার চেষ্টা করলে তাঁরা কৌশলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ দৌড়ে চলে যান। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রাতে একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে কয়েকজন পরীক্ষার্থী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসেন। সেখানে সাংবাদিকেরা গেলে কৌশলে পালিয়ে আবার একই এলাকায় আরএমওর বাসায় যান তাঁরা।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া কয়েকজনসহ চাকরিপ্রার্থী ও তাঁদের কয়েকজন অভিভাবক শহরের এন এস রোডে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। তাঁরা পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা বেলা ১টা ৩৩ মিনিটের দিকে নতুন দুটি তালা এনে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান ফটকে লাগিয়ে দেন।
বিক্ষোভকারীরা তালা দেওয়ার আগে দুপুর ১২টার দিকে সিভিল সার্জন শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পাঁচ সদস্যের কমিটি আছে। সেখানে তিনি সদস্যসচিব। পরীক্ষার আগের রাতে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একটি কক্ষে সব সদস্য মিলে প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। প্রশ্নপত্র ফটোকপিসহ বিভিন্ন কাজে আরও কয়েকজন ছিলেন। যাঁরা প্রশ্নপত্র তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সবার ফোন বন্ধ করে রাখা হয়। প্রশ্নপত্র বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গতকাল সকাল আটটার পর প্রশ্নপত্র কেন্দ্রগুলোয় পাঠানো হয়। আর আরএমও নিয়োগ–সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে জড়িত নন। যে অভিযোগ আসছে, তা পুলিশ তদন্ত করতে পারে।
এদিকে নিয়োগপ্রক্রিয়ার সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় থাকা কমিটির এক সদস্য নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, শুক্রবার রাতেই বিস্তারিত ঘটনা তুলে ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ঘটনার তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হোক। তদন্ত শেষে যদি অনিয়মের কোনো সত্যতা না পাওয়া যায় তবে খাতা দেখা এবং ফলাফল ঘোষণার কাজ চালাবেন। তার আগে সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। কমিটির চার সদস্যই কুষ্টিয়াতে আছেন। শুধু সিভিল সার্জন তাঁর কার্যালয়ে রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পরীক্ষার খাতাসহ সবকিছু সিভিল সার্জন কার্যালয়ে রয়েছে। সেগুলো জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।