দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, সম্পদ ফুলিয়ে দেখানো, অস্বচ্ছ আর্থিক বিবরণী এবং ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের চাপে ধুঁকে ওঠা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাত পুনর্গঠনে বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘ব্যাংক রেজুলিউশন অর্ডিন্যান্স-২০২৫’ অনুযায়ী ৯টি এনবিএফআইকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসায়নের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড। 
রবিবার গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফেরানো ও দীর্ঘস্থায়ী অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে এটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে কঠোর ও সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।


যে ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে ॥ এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। 


এই ৯ প্রতিষ্ঠানের দায়েই রয়েছে এনবিএফআই খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৫২ শতাংশ, যার পরিমাণ ২০২৪ সালের শেষে দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। এছাড়া আট প্রতিষ্ঠানের শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য দীর্ঘদিন ধরেই ঋণাত্মক, যা দেখায় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। বোর্ড অনুমোদনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, লিকুইডেটর নিয়োগ, সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে পাওনা আদায় এবং আমানতকারী-পাওনাদারদের মধ্যে বণ্টনের প্রক্রিয়া শুরু করবে।


আমানতকারীদের সুরক্ষায় সরকারের বিশেষ বরাদ্দ ॥ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থতা। অনেক গ্রাহকের স্কিম, ডিপোজিট বা এফডিআর বহু বছর আগেই পরিপক্ব হয়েছে, কিন্তু তারা বারবার গেছেন, অপেক্ষা করেছেন, তবুও টাকা পাননি।
পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, অবসায়নের আগে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া হবে এবং এ বিষয়ে সরকারের মৌখিক অনুমোদন ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে।


গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘গ্রাহকের টাকা ফেরত নিশ্চিত করেই লিকুইডেশন শুরু হবে। 
সরকার প্রাথমিকভাবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার মৌখিক অনুমোদন দিয়েছে। এক টাকাও যেন কেউ হারায় না এটিই আমাদের প্রধান দায়িত্ব।’


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ৯ প্রতিষ্ঠানের মোট আটকে থাকা আমানত, ১৫,৩৭০ কোটি টাকা এর মধ্যে, ব্যক্তি গ্রাহকের আমানত : ৩,৫২৫ কোটি। ব্যাংক ও করপোরেট আমানত : ১১,৮৪৫ কোটি। সবচেয়ে বেশি আটকে আছে, পিপলস লিজিং : ১,৪০৫ কোটি টাকা, আভিভা ফাইন্যান্স : ৮০৯ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং : ৬৪৫ কোটি টাকা, প্রাইম ফাইন্যান্স : ৩২৮ কোটি টাকা, এফএএস ফাইন্যান্স : ১০৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ব্যক্তিগত আমানতকারীদের পাওনা ফেরতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।


কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা হলো : শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, বহুবছর ধরে, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, সম্পদ ও আয় ফুলিয়ে দেখানো, আগের লোকসান গোপন করা, পরিচালক পর্যায়ের অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব ও ঋণ অনুমোদনে স্বচ্ছতার অভাব। এসব কারণে এনবিএফআই খাত ‘অচল অবস্থায়’ পৌঁছায়।
১০ মাসের বিশেষ মূল্যায়নে মোট ২০টি প্রতিষ্ঠানকে ‘লাল ক্যাটাগরি’তে রাখা হয়, যার মধ্য থেকে প্রথম ধাপে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের জন্য নির্বাচিত করা হয়। অন্যান্য ১১ দুর্বল প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আছে, সিভিসি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, উত্তরা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।
এর আগে দুর্বল ৫ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার ৯ এনবিএফআই বন্ধ, দুটি সিদ্ধান্তই আর্থিক খাত সংস্কারে দৃঢ় অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।