সন্ধ্যা নামলেই রাজশাহীর নগর যেন নতুন এক রূপ নেয়। মনিচত্বর, সাহেববাজার, নগরভবন, উপশহর কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিনোদপুর, ভদ্রা, কাজলা সব জায়গায় আলো ঝলমলে ছোট ছোট ফুড কার্ট সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। রঙিন লাইটের ঝিলিক, ভাজার তেলের ঝাঁজ, কফির ধোঁয়া আর ফলের জুসের ঘ্রাণ যেন পথচারীদের ডাক দিয়ে টানে। কেউ ক্লাস শেষে বন্ধু নিয়ে, কেউ অফিস থেকে ফেরার পথে, আবার কেউ পরিবারসহ এই কার্টগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে যায়। ফুড কার্ট রাজশাহীর খাবারের সংস্কৃতিতে যুক্ত করেছে এক নতুন মাত্রা। প্রতিটি কার্ট যেন আলাদা জগৎ। নগরভবনের সামনে ভাজা সিঙ্গারা-সমুচার দোকান, উপশহরে শর্মা ও চিকেন রোল, সাহেববাজারে মিল্কশেক ও আইসক্রিম, মনিচত্বরে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও বার্গার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভদ্রা এলাকায় কফি ও ফুচকার সারি প্রতিটি জায়গাই মানুষে ঠাসা।
সব খাবারের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে ফুচকা, বার্গার ও ফ্রাইড চিকেন। শিক্ষার্থীদের আড্ডা মানেই ফুচকার স্টল, আর তরুণদের প্রিয় ফাস্টফুড হিসেবে বার্গার ও চিকেনের কদর প্রতিদিনই বাড়ছে।
ফুড কার্ট শুধু খাবারের জায়গা নয়, শিক্ষার্থীদের আড্ডা ও সামাজিকীকরণের কেন্দ্রও। তারা সাশ্রয়ী দামে আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে এই কার্ট গুলোতে।
রাজশাহী কলেজের ছাত্রী তানজিলা আক্তার বলেন, আমরা প্রায়ই ক্লাস শেষে মনিচত্বর বা সাহেববাজারে যাই। এখানে বার্গার, ফ্রাইড চিকেন, কফি সবকিছু একসঙ্গে পাওয়া যায়। দামও আমাদের সাধ্যের মধ্যে।
ফুড কার্ট নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আত্মনির্ভরতার সুযোগ তৈরি করছে। ছোট বিনিয়োগ দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে বড় হওয়ার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখছে এই কার্ট গুলো।
নগরভবনে এলাকায় বার্গার বিক্রি করেন তরুণ উদ্যোক্তা সাব্বির হোসেন। তিনি বলেন, চাকরি না পেয়ে খুব হতাশ ছিলাম। পরে পরিবারের সহায়তায় দুই লাখ টাকা দিয়ে এই ফুড কার্ট চালু করি। এখন দিনে গড়ে তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা বিক্রি হয়। খরচ বাদেও ভালো আয় থাকে। ভবিষ্যতে স্থায়ী দোকান খোলার পরিকল্পনা করছি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই বার্গারের কার্ট চালান স্নাতকোত্তর শেষ করা সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন,শুধু ক্লাসের বই পড়লেই চাকরি পাওয়া যায় না। তাই আমি উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন দিনে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বিক্রি হয়। অনলাইনে অর্ডারও পাচ্ছি। এতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
সাইফুলের বক্তব্যে ফুটে ওঠে দেশের শিক্ষিত তরুণদের বিকল্প পথের খোঁজ। চাকরির নির্ভরতা না করে তারা ব্যবসা শুরু করে নিজেই কর্মসংস্থান তৈরি করছেন। এতে করে চাকরির জন্য হতাশা ও বাড়ছে না এবং শিক্ষিতরা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন
উপশহরের বিক্রেতা রফিকুল আলম জানান, আমি আগে ঢাকায় হোটেলে চাকরি করতাম। করোনার পর রাজশাহীতে ফিরে এসে কার্ট চালাই। এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। কার্ট ছোট হলেও স্বপ্নটা বড়। নগরভবনের সামনে ফুচকার কার্ট থেকে খাচ্ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী রাশেদুল ইসলাম। তিনি বললেন,অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে এখানে দাঁড়াই। ফুচকা, চটপটি কিংবা জুস দ্রুত খাওয়া যায়, দামও রেস্টুরেন্টের তুলনায় কম। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, জায়গা বরাদ্দ, পৌরসভার অনুমতি ও স্বাস্থ্যবিধির অনিশ্চয়তা বড় চ্যালেঞ্জ। আবার মৌসুমভেদে বিক্রিতে ওঠানামা হয়। তবুও তারা এটিকে সম্ভাবনার খাত হিসেবেই দেখছেন।রাজশাহীর ফুড কার্ট এখন শুধু খাবার বিক্রির জায়গা নয়; এটি শহরের মানুষের আড্ডার কেন্দ্র, তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বপ্নের আঁকিবুঁকি, আবার পরিবার-বন্ধুর সঙ্গে ছোট্ট সুখ খোঁজার আসর। সঠিক পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ও প্রশাসনিক সহযোগিতা পেলে রাজশাহীর অর্থনীতিতেও এই ফুড কার্ট এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।
ইবতিদা ফেরদৌস