দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও বিভিন্ন আঘাতে প্রতি বছর হাজারো মানুষ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এখনো এই রোগীদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি, প্রোটোকল বা পুনর্বাসন কাঠামো নেই। বিভাগীয় শহরে সীমিত কিছু সুবিধা থাকলেও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা প্রায় অপ্রতুল। ফলে সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে রোগীরা আজীবন শারীরিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন।

রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বনানীর প্লাটিনাম গ্র্যান্ড হোটেলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) পরিচালিত জাতীয় গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের সব বিভাগীয় মেডিকেল কলেজে সিটি স্ক্যান থাকলেও এমআরআই সুবিধা রয়েছে মাত্র ৮৫.৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। জেলা হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১২.৫ শতাংশে এ  দুই ধরনের সুবিধা একসঙ্গে আছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এমআরআই বা সিটি স্ক্যান কোনো সুবিধাই নেই।

ফলে দুর্ঘটনার পর রোগীকে প্রাথমিক ধাপে সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাও সীমিত। এ কারণে প্রাথমিক চিকিৎসায় দেরি হয়, যা অনেক সময় রোগীর জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

শতকরা ৯০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য প্রশাসক জানিয়েছেন, ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, পুনর্বাসন নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল নেই। কোনো জাতীয় রেজিস্ট্রি না থাকায় সঠিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় না।

আলোচনা সভায় উপস্থিত কয়েকজন মেরুরজ্জু আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। একজন জানান, দুর্ঘটনার পর সঠিক সময়ে ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন সেবা না পাওয়ায় তিনি এখন পুরোপুরি কর্মক্ষম নন। আরেকজন বলেন, ‘আমরা যদি সময়মতো পুনর্বাসন সেবা পেতাম, তবে সমাজে অবদান রাখতে পারতাম। কিন্তু চিকিৎসা ও সেবার অভাবে আমাদের জীবনে স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।’

ঢাকা বিভাগের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মেরুরজ্জু আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের জন্য এখনো কোনো সুসংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি কিন্তু ধীরে ধীরে এই রোগীদের সেবাও সরকারি স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত হবে। সরকারের পরিকল্পনায় এটি ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসির অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, ‘পুনর্বাসন কোনো বিশেষ সুবিধা নয়, এটি আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের অধিকার। অনেক সময় দেখা যায় চিকিৎসা শেষ হলেও রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না, কারণ পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নেই। তাই এখনই নীতি পর্যায়ে পুনর্বাসনকে স্বীকৃতি দিতে হবে।’

সিবিএম গ্লোবাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘এই গবেষণা শুধু তথ্য দেয়নি, বরং ভবিষ্যতে নীতিনির্ধারণের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করেছে। স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি কেবল চিকিৎসার বিষয় নয়, এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি করে। তাই পুনর্বাসন ব্যবস্থাকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির মূলধারায় আনতে হবে।’

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘একজন স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি রোগীর পূর্ণ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে শুধু চিকিৎসক যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন ইন্টারডিসিপ্লিনারি দল—ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, মনোবিজ্ঞানী ও পুনর্বাসন নার্স। এই সমন্বয় ছাড়া কার্যকর সেবা সম্ভব নয়।’

গবেষকরা জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এবং প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর আওতায় মেরুরজ্জু আঘাতপ্রাপ্তদের পুনর্বাসন অন্তর্ভুক্ত করা, সরকারি বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, পুনর্বাসন পেশাজীবীদের নিয়োগ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে মডেল পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলার সুপারিশ করেন।

অনুষ্ঠানের শেষে সিআরপির পক্ষ থেকে প্রধান অতিথির কাছে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পুনর্বাসন সেবা অন্তর্ভুক্তির জন্য একটি সুপারিশপত্র হস্তান্তর করা হয়।