মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কূটনৈতিক সমাবেশের আয়োজন হতে যাচ্ছে। তিন দিনব্যাপী ৪৭তম আসিয়ান সম্মেলনে অংশ নেবেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ অংশীদাররা। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য— ‘ইনক্লুসিভিটি অ্যান্ড সাস্টেইনেবিলিটি’।
প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে আসিয়ান মহাসচিব ড. কাও কিম হর্ন নেতৃত্ব দেবেন আসিয়ান সেক্রেটারিয়াটের প্রতিনিধি দলকে। আশা করা হচ্ছে, এবারের সম্মেলন হবে ১৯৭৬ সালের পর সবচেয়ে বড় আকারের আসিয়ান আয়োজন। সম্মেলনে অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো প্রাধান্য পাবে। নেতারা পর্যালোচনা করবেন ‘আসিয়ান ট্রেড ইন গুডস এগ্রিমেন্ট (এটিগা)’ সংশোধনের অগ্রগতি এবং ‘ডিজিটাল ইকোনমি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (ডিফা)’ আলোচনার অগ্রগতি— যা আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রবাহ ও ডিজিটাল সংযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘ট্রিটি অব অ্যামিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন (টিএসি)’ চুক্তিতে যোগদানের স্বাক্ষর অনুষ্ঠান, ৫ম ‘আরসিইপি’ শীর্ষ সম্মেলন এবং ‘আসিয়ান প্রাইজ’ প্রদান অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হবে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এবারের সম্মেলনে টিমর-লেস্তেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আসিয়ানের ১১তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণ করা হবে। ১৯৯৯ সালের পর এটিই আসিয়ানের প্রথম সম্প্রসারণ, যা মালয়েশিয়ার সভাপতিত্বে একটি ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই সদস্যপদ প্রাপ্তির মাধ্যমে টিমর-লেস্তে ‘আফটা’ ও ‘আরসিইপি’ বাণিজ্য চুক্তির সুবিধা, উন্নয়ন সহায়তা, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা পাবে।
সম্মেলনে অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি মিয়ানমারের চলমান সংকট, দক্ষিণ চীন সাগরের সামুদ্রিক বিরোধ, সাইবার নিরাপত্তা ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ মোকাবিলা নিয়ে গভীর আলোচনা হবে। বিশেষ নজর থাকবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে আসিয়ান কীভাবে ঐক্য বজায় রাখে, সে বিষয়েও।
এই আয়োজনকে ঘিরে কুয়ালালামপুরে জড়ো হচ্ছেন বিশ্বনেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ানতো, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লরেন্স ওয়ং, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন মানেত, ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিনহ, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র, লাওসের প্রধানমন্ত্রী সোনেক্সাই সিফানদোনে এবং টিমর-লেস্তের প্রেসিডেন্ট হোসে আলেক্সান্দ্রে গুসমাও উপস্থিত থাকবেন। অন্যদিকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিও উপস্থিত থাকবেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি যোগ দিচ্ছেন না; তাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন যথাক্রমে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং এবং রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নভাক। এছাড়াও ‘আসিয়ান প্লাস’ কাঠামোর আওতায় চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেবেন। একইসঙ্গে ‘ইস্ট এশিয়া সামিট’ এবং ‘আসিয়ান বিজনেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিট’-ও অনুষ্ঠিত হবে।
উচ্চ পর্যায়ের এই সম্মেলন উপলক্ষে রাজধানীজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তিন দিনব্যাপী আয়োজনে হাজার হাজার প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী ও সহায়ক কর্মী অংশ নেবেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। সরকার নির্দিষ্ট রুটে সরকারি যানবাহনের জন্য অস্থায়ী সড়ক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করেছে। কুয়ালালামপুর পুলিশ প্রধান কমিশনার দাতুক ফাদিল মারসুস জনগণকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজধানীজুড়ে ১০,০০০-এর বেশি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
সম্মেলনের সমাপনী দিনে মালয়েশিয়া ২০২৬ সালের জন্য আসিয়ান সভাপতিত্ব হস্তান্তর করবে ফিলিপাইনসের কাছে। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, কুয়ালালামপুর সম্মেলন আসিয়ানের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য— একটি সমন্বিত আঞ্চলিক অর্থনীতি গঠন এবং জটিল বৈশ্বিক পরিবেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।