বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক বর্তমানে নতুন মাত্রায় প্রবেশ করেছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কৌশলগত নিরাপত্তা, পানি ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যসেবায় বিস্তৃত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায় “বাংলাদেশ এখন চীনের কৌশলগত সহযোগিতার নতুন কেন্দ্রবিন্দু।”
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হলেও, ২০২৫ সালে এসে তা নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান, এবং এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সবাই চীন সফর করেছেন। এসব সফরের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় পর্যায়ে যোগাযোগ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিএনপি ও জামায়াতের সফরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে পার্টি–টু–পার্টি সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে, যা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন কূটনৈতিক সমীকরণ তৈরি করতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের মার্চ মাসের চীন সফরে বাংলাদেশ পেয়েছে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি। পাশাপাশি ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের চীনে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে—যা বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পর আরও দুই বছর বহাল থাকবে।
চট্টগ্রামের অনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩০টি কোম্পানির ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ, তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা এবং পানি ব্যবস্থাপনায় ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি—সবই এই সফরের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
এ ছাড়া চীনের তৈরি পোশাক, বৈদ্যুতিক যান, ইলেকট্রনিক্স ও সৌর শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তরের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বেইজিং। এর ফলে বাংলাদেশে চীনা ম্যানুফ্যাকচারিং হাব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যা লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ যেখানে পানি জীবন ও চ্যালেঞ্জ দুটিই। ড. ইউনূসের চীন সফরে তিস্তা নদী, ঢাকার চারপাশের নদী ও পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণে চীনের কারিগরি সহায়তা চাওয়া হয়।
চীনের পানিসম্পদমন্ত্রী লি গুয়োইং বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেওয়ার আশ্বাস দেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের পানি ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে বাংলাদেশ বন্যা ও নদী দখল সংকট মোকাবিলায় নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে।
চীনের সহায়তায় বাংলাদেশে তিনটি বড় হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—
- নীলফামারীতে ১ হাজার শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল
- চট্টগ্রামে ৫০০–৭০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল
- ঢাকার ধামরাইয়ে পুনর্বাসন হাসপাতাল
চীন সরকার এই প্রকল্পগুলোকে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বন্ধুত্বের উপহার হিসেবে বিবেচনা করছে। এছাড়া চীনের কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতাল ইতোমধ্যে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হয়েছে যা ভারতীয় মেডিকেল ভিসা সংকটের পর বিকল্প চিকিৎসা গন্তব্য হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
অক্টোবরে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ–চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুই দেশের অতীত সহযোগিতা স্মরণ করা হয় এবং ভবিষ্যতের কৌশলগত অংশীদারত্বের রূপরেখা নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলাম ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, “চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু অবকাঠামো নয়, বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানি ভারসাম্য ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের দিকেও নজর দিতে হবে।”
অন্যদিকে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, “চীন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে রেল ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগে আগ্রহী, যা ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক রূপান্তরে সহায়ক হবে।”
ইএফ/