রাজধানীর গুলশানের শহীদ তাজউদ্দিন পার্কটি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে পুরোপুরি বাণিজ্যিক দখলে চলে যাচ্ছে। একসময় যেখানে এলাকার শিশু-কিশোররা বিনামূল্যে খেলাধুলা ও বিনোদনে সময় কাটাত, এখন সেই সুযোগ আর অবারিত নেই। স্থানীয়দের গুরুতর অভিযোগ, পার্কের ফুটবল টার্ফটি বর্তমানে ঘণ্টায় আট হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়ায় ব্যবহৃত হচ্ছে, ফলে সাধারণ নাগরিকদের জন্য সেখানে খেলার কোনো সুযোগ নেই।

জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অমান্য করে গুলশান ইয়ুথ ক্লাব ও গ্রিন সেভারর্স নামে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে পার্কটির অংশবিশেষ তুলে দিয়েছে। পরিবেশবিদ ও নাগরিক সংগঠনগুলো এই পদক্ষেপকে 'বৃক্ষসেবার আড়ালে ব্যবসা ও দখল' হিসেবে দেখছে, যা শিশুদের খেলাধুলার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।

পার্কটি গণপূর্ত বিভাগ থেকে ডিএনসিসিকে হস্তান্তর করার চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে এটি অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। তবুও সাবেক মেয়রের আমলে গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ফুটবল টার্ফসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ ও মাঠ ভাড়া দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এমনকি নতুন প্রশাসনও সেই একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গ্রিন সেভারর্সকে অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ হলো, ২০০০ সালের 'খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন' অনুযায়ী কোনো উন্মুক্ত স্থান ইজারা, ভাড়া বা অন্যভাবে হস্তান্তর করা সম্পূর্ণ বেআইনি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৫, ২০০৯ ও ২০১৩ সালে হাইকোর্টের তিনটি পৃথক রায়ে পার্ক বা খেলার মাঠে বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং সব অবৈধ স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ডিএনসিসি এই রায়গুলো বারবার অমান্য করে চলছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "এই মাঠটা জনগণের মাঠ। এখানে কোনো ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা চলতে পারে না। এখন নির্দিষ্ট ফি না দিলে শিশুদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।"

বর্তমানে ক্লাব সদস্য না হলে বা নির্দিষ্ট ফি না দিলে মাঠে প্রবেশ ও খেলাধুলা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোররা। নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “এটা জনগণের সম্পত্তি, কাউকে ভাড়া দেওয়া বা ইজারা দেওয়া স্পষ্টতই অপরাধ। জনস্বার্থ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পার্কগুলো ভাড়া দেওয়া যায় না।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, সরকারি সংস্থা হয়ে সিটি করপোরেশন কীভাবে জনগণের সম্পত্তি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তুলে দেয়?

নাগরিক সমাজ দ্রুত এই অবৈধ চুক্তি বাতিল করে আদালতের নির্দেশনা অনুসারে পার্ক, মাঠ ও জলাধার জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। মাঠ দখলমুক্ত আন্দোলনের সদস্যরা ঘোষণা দিয়েছেন, তারা ডিএনসিসি ও ইয়ুথ ক্লাবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তবে ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি, যা পুরো ঘটনাটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।

ইএফ/