সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকায় একের পর এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রকাশ্যে অস্ত্রধারীদের দোকানপাট, অফিস-আদালতে ঢুকে টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা বাড়ছে। বছরের প্রথম ১০ মাসেই (জানুয়ারি–অক্টোবর) ঢাকায় ১৯৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে—যা গত কয়েক বছরের বার্ষিক পরিসংখ্যানকেও ছাড়িয়ে গেছে।

আগের বছরের তুলনায় মারাত্মক বৃদ্ধি

ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী—

  • ২০২৩ সালে: ১৬৫
  • ২০২২ সালে: ১৭২
  • ২০২১ সালে: ১৬৬
  • ২০২৪ সালের ১০ মাসেই: প্রায় ২০০টি হত্যাকাণ্ড

সূত্র বলছে, আগের পুরো বছরের তুলনায় এবার ১০ মাসেই ৩০–৩৫টি বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নভেম্বরেও বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে পুরান ঢাকা ও পল্লবীর হত্যাকাণ্ড দুইটি বিশেষভাবে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

পুরান ঢাকা থেকে পল্লবী—একই কায়দায় টার্গেট কিলিং

১০ নভেম্বর, পুরান ঢাকার আদালতপাড়ার কাছে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। এর মাত্র এক সপ্তাহ পর ১৭ নভেম্বর পল্লবীতে একই কায়দায় গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে

  • সিসিটিভিতে দেখা যায়, তিনজন অস্ত্রধারী দোকানে ঢুকে ১০ সেকেন্ডেই কিলিং মিশন শেষ করে চলে যায়।
  • হত্যামিশনে অংশ নেয় ৬ জন—৩ জন শুটার, ৩ জন ইনফর্মার।
  • ঘটনার পর একজন (জনি) গণপিটুনির পর পুলিশের হাতে আটক হয়।

এ ছাড়া বাড্ডা, গুলশানসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্যে গুলি করে খুনের ঘটনা বাড়ছে।

টার্গেট কিলিং বাড়ার পেছনে কারণ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধির মূল কারণগুলো:

  • রাজনৈতিক প্রতিহিংসা
  • এলাকায় আধিপত্য বিস্তার
  • দীর্ঘদিনের ব্যক্তি শত্রুতা
  • মাদক ও চাঁদাবাজি ব্যবসার দ্বন্দ্ব
  • নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় অন্তর্কলহ
  • শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর পুনরায় সংগঠিত হওয়া

অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোযোগ অন্যদিকে সরে যাওয়ায় সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।

রাজনৈতিক আশ্রয়ে সংগঠিত হয়ে নতুন অপরাধ জগৎ

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অভিযোগ, ৫ আগস্টের পর যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বের হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে। তারা পুরোনো নেটওয়ার্ক সক্রিয় করে নতুন অপরাধ চক্র গড়ে তুলছে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন—

“দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে বের হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল নড়বড়ে হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে।”

তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবও অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান

ডিএমপির হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮টি হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই—

  • পারিবারিক বিরোধ
  • পূর্ব শত্রুতা
  • আধিপত্য বিস্তার
  • মাদক সংশ্লিষ্ট

ডিএমপি জানায়, সাম্প্রতিক বেশিরভাগ খুনের রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে, অনেক অস্ত্র উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেপ্তারও হয়েছে।

ডিবি পুলিশের কর্মকর্তারাও দাবি করেছেন, সব ঘটনার তদন্তে তারা সফল হয়েছেন। ২৬ টুকরো লাশ উদ্ধার, পুরান ঢাকার খুন—এসব ঘটনারও রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে।

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে নির্বাচন ঘিরে খুন-সন্ত্রাস আরও বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন—

“নির্বাচন সামনে—তাই আইনশৃঙ্খলা এখন বড় ইস্যু। আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে পারলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।”