দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট শহর-গ্রাম, শিল্প ও কৃষি সবখানেই গভীর প্রভাব ফেলছে। বিদ্যুৎ এসে হঠাৎই চলে যাচ্ছে, কখনো দীর্ঘ লোডশেডিং আবার কখনো গ্যাসচাপ এত কম যে, চুলায় আগুনই জ্বলে না। একদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে জ্বালানি নেই, অন্যদিকে আমদানি খরচ বেড়ে অর্থনীতি জর্জরিত। এমন কঠিন পরিস্থিতি শুধু বর্তমান নয়; বরং ভবিষ্যৎ জ্বালানি নীতির দিকেই বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্থায়ী ও নিরাপদ জ্বালানির একমাত্র সম্ভাবনা হলো নবায়নযোগ্য শক্তি, যা পরিবেশ ও অর্থনীতি দুটোই সমৃদ্ধ করবে।

উন্নয়নশীল বাংলাদেশে শিল্পায়ন বাড়ছে, কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী বেশি এবং শহরমুখী জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন। কিন্তু দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা, আমদানিনির্ভরতা, বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে দেশ আজ সবচেয়ে বড় জ্বালানি সংকটে রয়েছে।

উত্তরাঞ্চলের কৃষিপ্রধান জেলা রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে বোরো মৌসুমে সেচ পাম্প চলার আশঙ্কা কৃষকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কখনো রাতভর অপেক্ষা করেও সেচ সম্ভব হয় না, আবার গ্যাসচাপ কম থাকায় উৎপাদন কমে এবং খরচ বেড়ে যায়। কৃষক ও শ্রমিকরা বলছেন, জ্বালানি সংকট এখন কৃষিকাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অচল হয়ে যায়। কয়লার বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবহন সংকট মৎস্য ও হিমায়িত খাদ্যশিল্পকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কয়েক মিনিট বিদ্যুৎ না থাকলেও কোটি কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়, শ্রমিকরা কাজ হারান, মালিকেরা লোকসানে ডুবে যান।

পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারও বিপন্ন। শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল, তাই বিদ্যুৎ না থাকলে ক্ষতি হয়। পর্যটন খাতও বিদ্যুৎ–গ্যাস সংকটে প্রভাবিত। রাজধানী ঢাকাও মুক্ত নয়; গ্যাস না থাকলে রান্না হয় না, বিদ্যুৎ না থাকলে এলিভেটর থেমে যায়, হাসপাতাল ও অফিস কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

বিশ্বের অনেক দেশ নবায়নযোগ্য শক্তিতে দ্রুত বিনিয়োগ করছে। সৌর, বায়ু, বায়োমাস ও সবুজ হাইড্রোজেনের মাধ্যমে তারা আমদানিনির্ভরতা কমাচ্ছে। বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণে এই প্রতিযোগিতায় বিপদ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো সময় আছে। দেশের স্কুল-কলেজ, ইউনিয়ন ভবন, বাজার ও ঘরের ছাদ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করলে এক হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

Power3_20251126_065833940

বায়ুশক্তিতেও সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে কক্সবাজার ও মহেশখালী–সোনাদিয়া অঞ্চলে। ছোট-মাঝারি উইন্ড টারবাইন স্থাপন করলে স্থায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। প্রথমে পাইলট প্রকল্প শুরু করতে হবে। দেশের স্থায়ী ও নিরাপদ জ্বালানির জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি একমাত্র বিকল্প। সঠিক নীতি, বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করলে বিদ্যুতের অভাব কমবে, আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে এবং অর্থনীতি ও কৃষি কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে।

শিল্পমালিকরা বলছেন, যন্ত্রপাতির ডিজাইনই এমন যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকলে একেকটি প্ল্যান্ট রাতে তিনবার বন্ধ হয়ে যায়। আর প্রতিবার বন্ধ হওয়ার অর্থ হলো লাখ লাখ টাকার ক্ষতি। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পও প্রায় একই অভিজ্ঞতা জানাচ্ছে—গরমে হোটেল-রিসোর্টে বিদ্যুৎ না থাকলে পর্যটকরা সেবার মান নিয়ে ক্রমাগত অভিযোগ করছেন।

তবে দেশের গবেষক ও পরিবেশবিদরা বলছেন—এখনো সময় আছে, কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা সৌরবিদ্যুৎ, কারণ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান সৌরশক্তির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের ছাদ ব্যবহৃত হলে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। গ্রামাঞ্চলে ছড়ানো ঘরবাড়ি, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, বাজারের ছাদ সবই সৌরবিদ্যুতের জন্য সম্ভাবনাময় স্থান। কিন্তু প্রয়োজন সঠিক নীতি ও বিনিয়োগ।

বায়ুশক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলেও সম্ভাবনা আছে। কক্সবাজার উপকূল ও মহেশখালী–সোনাদিয়া এলাকায় গবেষণায় দেখা গেছে—মাঝারি থেকে উচ্চ বেগের বায়ুপ্রবাহ প্রায় সারা বছরই থাকে, যা ছোট-মাঝারি উইন্ড টারবাইনের জন্য উপযোগী। উন্নত দেশগুলো এখন সমুদ্রবায়ু বা অফশোর উইন্ডের মাধ্যমে বিশাল পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে আনতে হলে প্রথমে উপকূলীয় এলাকায় পাইলট প্রকল্প শুরু করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবায়নযোগ্য শক্তি শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক। সৌর প্যানেল একবার স্থাপন করলে ২০–২৫ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ দেওয়া যায়। এতে কোনো জ্বালানি আমদানি করতে হয় না, বৈদেশিক মুদ্রার চাপও কমে। একইভাবে বায়ুশক্তি টারবাইনের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ খুবই কম। কৃষি-বর্জ্য, জৈব বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য—এসব থেকে বায়োমাস বিদ্যুৎও উৎপাদন করা সম্ভব।

পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, জ্বালানি সংকট কাটাতে হলে নবায়নযোগ্য শক্তিকে শুধু বিকল্প হিসেবে নয়—মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বলছে, আমরা যত দ্রুত টেকসই জ্বালানির দিকে যাব, তত দ্রুত অর্থনীতি ও মানুষের জীবন স্বাভাবিক হবে। বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট শুধু বিদ্যুতের সুইচ-অন–অফ নয়—এটি মানুষের জীবনমান, অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলছে। প্রতিটি জেলা-উপজেলার গল্প ভিন্ন হলেও সংকটের মূল কারণ একই- আমদানিনির্ভরতা এবং অপরিকল্পিত জ্বালানি নীতি।

আরেক গবেষক বলেন, আর্টিক্যাল ৬-এর মাধ্যমে কার্বন বাণিজ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে পারলে কয়েকশ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় সম্ভব। এই অর্থ নবায়নযোগ্য শক্তি অবকাঠামোতে ব্যবহার করা গেলে দেশের জ্বালানি খাত পাল্টে যেতে পারে। নবায়নযোগ্য শক্তি শুধু জ্বালানি সংকট সমাধানই করবে না; একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিও কমাবে। বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে, ঘূর্ণিঝড় বাড়ছে, উপকূলের লবণাক্ততা বিস্তৃত হচ্ছে—এসবই জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিশ্বব্যবস্থার পরিণতি। নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর এসব ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমাবে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে সরকার ইতোমধ্যে কয়েকটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করেছে। তবে এগুলো এখনো প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। নবায়নযোগ্য শক্তিকে কেন্দ্র করে যদি একটি দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবায়নযোগ্য রোডম্যাপ নেওয়া যায়, তবে ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে এটি বড় ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব যখন নবায়নযোগ্য শক্তিকে ভবিষ্যৎ মনে করে দ্রুত এগোচ্ছে, তখন বাংলাদেশ সেই দৌড়ে স্থির থাকলে চলবে না। কারণ সংকট এখনই; সমাধানও এখনই দরকার। বাংলাদেশের সামনে দুটি পথ—একটি পুরোনো, অনিশ্চিত, আমদানিনির্ভর; অন্যটি নবায়নযোগ্য, নিজের উৎপাদন, ভবিষ্যৎ-নিরাপদ পথ। কোন পথে যাবে বাংলাদেশ, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম. শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, জ্বালানি খাতকে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে সরকার প্রতিষ্ঠিত করার নীতি অবলম্বনের ফলে সরকার নিজেই মুনাফা করছে, আর বেসরকারি মালিকানার ক্ষেত্রে এটি অলিগলি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারের কাজ হওয়া উচিত কল্যাণমূলক, যাতে জনসাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত হয়।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই খাতে দুর্নীতিতে জড়িত হচ্ছেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোও কাঠামোগতভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দুর্নীতি প্রতিরোধ না করা গেলে কোনোভাবেই সংকট সমাধান সম্ভব নয়। গত সরকারের আমলে এটি চরম আকার ধারণ করেছিল। বর্তমান সরকার সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং মূল্য কমানো ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে সরকারের চরিত্রগত পরিবর্তন এবং নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন।

ড. এম. শামসুল আলম বলেন, বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে লাভ হবে না। সঠিক পরিকল্পনা ও কম খরচে উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে, মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ১১-১২ টাকায় কেনা হলেও সমস্যার সমাধান হবে না। যদি পরিকল্পনা সঠিকভাবে করা হয়, তাহলে সাড়ে ৭ টাকায় বিদ্যুৎ গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে ২০-২৫% এবং আমদানি খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। অতএব, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি একটি বাস্তবসম্মত ও বিকল্প সমাধান, তবে এর কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা অপরিহার্য।

ইএফ/