ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘণ্টা ইতোমধ্যে বেজে গেছে। আর মাসখানেক পরেই ডিসেম্বরের শুরুতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে নির্বাচনের দিনক্ষণ। আগামী ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে গঠিত নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন পরিচালনা করবে। পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর একটি প্রশ্নাতীত এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য গোটা জাতি মুখিয়ে আছে। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কোনো কোনো ভূমিকায় তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। রাজনীতিবিদরা প্রতিষ্ঠানটির প্রতি ছুড়ছেন অভিযোগের তীর।

জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দলীয় প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে ইসির নিরপেক্ষতা নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। নবগঠিত দলটি শুরু থেকেই তাদের প্রতীক হিসেবে শাপলা দাবি করে আসছিল। তবে নির্বাচন কমিশন শাপলা প্রতীক না দেওয়ার ব্যাপারে শুরু থেকেই অনড় ছিল। নানা দেন-দরবারের পর গত বৃহস্পতিবার প্রতীকের তালিকায় ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করে বিধিমালায় সংশোধন আনে ইসি। এটাকে চাপের কাছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির নথি স্বীকার করা বলে মনে করছেন কোনো কোনো রাজনীতিবিদ। যদিও এই সিদ্ধান্তেও এনসিপিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি ইসি। তরুণদের নেতৃত্বাধীন দলটি দাবি করেছে, শাপলা কলি নয়, তাদেরকে শাপলাই দিতে হবে।

শাপলা কলিকে প্রতীক তালিকায় যুক্ত করাকে চাপের কাছে কমিশনের নথি স্বীকার হিসেবে দেখছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এটা নির্বাচন কমিশনের সারেন্ডার করার মানসিকতা। কেউ শাপলা চাইলে তারা শাপলার কলি দিয়ে দিচ্ছে-এটা জাতীয় ক্ষতি। আগে শাপলা ছিল, এখন কলি দিল-এটাও এক ধরনের দ্বিচারিতা।’

মান্না বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের এই আচরণ তাদের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দেয়। এনসিপিকে অনেকে ‘কিংস পার্টি’ বলে, আর এসব ঘটনায় মনে হয় সরকারি মদদ ছাড়া এটা সম্ভব নয়।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এগুলো হাস্যকর ব্যাপার, এগুলো নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কথায় কথায় যদি আমরা বলি, নির্বাচনে যাব না, রাস্তায় নামব তাহলে শেখ হাসিনার সেই আমলের রাজনীতি আবার ফিরিয়ে আনতে চাইলে তো জনগণ তা মানবে বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহনশীলতা চায়, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ চায় এটাই জনগণের প্রত্যাশা। দ্বিমত পোষণ করুন, কিন্তু শ্রদ্ধাবোধ রেখে। কথায় কথায় রাজনীতি, প্রতিবাদ, তারপর নির্বাচনে যাব না-এই ধরনের আচরণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিষিয়ে তুলবে। বাংলাদেশের মানুষ সেটা চায় না।’

৩০ অক্টোবর এনসিপিকে ‘শাপলা কলি’ দেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘এনসিপিকে প্রতীক বরাদ্দের ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের দ্বিচারিতা স্পষ্ট। আগে বলেছিল সুযোগ নেই, পরে নতুন প্রতীক সংযোজন করল। এতে বোঝা যায়, তারা হয় পক্ষপাত করছে, নয়তো চাপের মুখে অবস্থান বদলেছে।’

তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, শাপলা কলি প্রতীক হিসেবে যুক্ত করা এটা কারও দাবি কিংবা চাপে নয়। এই সংযোজন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ভবিষ্যতে আবারও প্রতীক তালিকায় প্রয়োজনের তাগিদে সংযোজন-বিয়োজন হবে।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শাপলা কলি আর শাপলা দুটি ভিন্ন জিনিস। আমরা কোনো চাপ অনুভব করিনি। আমরা মনে করেছি, যেগুলো পুরনো মডেলের প্রতীক রয়েছে সেগুলোর মধ্যে কিছু বাদ দিয়ে নতুন যতগুলো আনা যায়। শাপলা কলি রাখতে কোনো বাধা নাই।’

গত বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) প্রতীকের তালিকা সংশোধন করে ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে ইসি। ওই দিন সন্ধ্যায় প্রতীকের তালিকা সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘এটা নির্বাচন কমিশন মনে করেছে যে, শাপলা কলিটা রাখা যেতে পারে। এটা কারো কোনো দাবির বিষয় নয়। এনসিপি শাপলা প্রতীক চেয়েছে, কিন্তু শাপলা ও শাপলা কলির মধ্যে পার্থক্য আছে এটাও আমার মনে হয় ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।’

এনসিপির চাপে প্রতীকের তফসিলে ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘শাপলা আর শাপলা কলির মধ্যে পার্থক্য আছে। নতুন প্রতীকগুলোর ভেতরে শাপলা কলি রাখা হয়েছে। এটা কারও দাবির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়।’

আখতার আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার তফসিলটা সংশোধন করেছি। কিছু কিছু প্রতীক নিয়ে মন্তব্য শুনেছি—যেমন কেউ বলেছে, এটা রাখলে কেন, না রাখলে ভালো হতো, রাখা কি যৌক্তিক হয়েছে কি না ইত্যাদি। এই বিবেচনায়, আগে যে ১১৫টি প্রতীক ছিল, তার মধ্যে ১৬টি বাদ দিয়ে নতুন করে প্রতীক নিয়ে ১১৯টি প্রতীক এবার শিডিউল করেছি। যদি ভবিষ্যতে প্রয়োজন হয়, আবার সংশোধন করা হবে। এটা কোনো স্থির বিষয় না, কোনো আইনবিধির প্রয়োজন হয় না... এখানে নতুন করে বিতর্কের যোগ দেখছি না।’

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল এনসিপির প্রতীক ইস্যুতে কিছুটা ছাড় দিয়ে বিকল্প হিসেবে ‘শাপলা কলি’ তালিকায় যুক্ত করেছে ইসি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির ধারণা ছিল, এনসিপি এটা মেনে নেবে। তবে ইসি মন যোগাতে পারেনি নবগঠিত দলটির। এনসিপি শাপলা ফুলকেই প্রতীক হিসেবে চায়। ‘শাপলা কলি’ তারা নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এমনকি ‘শাপলা কলি’ দিয়ে ইসি এনসিপি যে ‘বাচ্চাদের দল’ সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে বলেও অভিযোগ করেছেন দলটির কোনো কোনো নেতা।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) ‘শাপলা কলি’ প্রতীকের তালিকায় যুক্ত করে গেজেট প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা মেইলকে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জহুরুল ইসলাম মুসা বলেন, ‘আমাদের ‘শাপলা কলি’ দেওয়া হলে তা আমরা মানি না। আমরা শাপলাই চাই। শাপলা কলি প্রতীক তালিকায় যুক্ত করায় আমরা সন্তুষ্ট নই।’

প্রতীক ইস্যুতে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলে আসছি, এনসিপি শাপলা চায়। এনসিপি শাপলা নিয়ে নির্বাচন করবে। শাপলার প্রশ্নে আমরা আপসহীন-শাপলা নিয়ে আমরা একবিন্দু ছাড় দিতে চাই না।’

জানা যায়, গত ২২ জুন এনসিপি তাদের নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দেয় এবং তিনটি প্রতীক প্রস্তাব করে-শাপলা, কলম ও মোবাইল ফোন। পরে ৩ আগস্ট ও ২৪ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়ে তারা তাদের পছন্দ সংশোধন করে জানায়, তারা সাদা বা লাল শাপলা চায়।

২৩ সেপ্টেম্বর কমিশন নির্বাচনি প্রতীকের সংখ্যা ৬৯ থেকে বাড়িয়ে ১১৫ করে, তবে শাপলা বাদ রাখে। এর মধ্যে ৫১টি নিবন্ধিত দলকে দেওয়া হয়, বাকিগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকে।

এর মধ্যে ইসির সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ইসি এনসিপিকে চিঠি দিয়ে জানায়, অনুমোদিত প্রতীকের তালিকা থেকে একটি প্রতীক বেছে নিয়ে ৭ অক্টোবরের মধ্যে জমা দিতে হবে।

তবে শাপলাতে অনড় থাকে এনসিপি। বাধ্য হয়ে ফের প্রতীক পছন্দ করতে ইসির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয় তরুণদের গড়া এই দলকে, যেখানে প্রতীক পছন্দের জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত।

ওই চিঠির জবাবে এনসিপি ইসির কাছে লিখিতভাবে জানতে চায়, কোন মানদণ্ডে প্রতীক তালিকায় রাখা হয় বা বাদ দেওয়া হয়।

এর আগে একাধিকবার ইসি জানিয়েছিল, শাপলা প্রতীক তালিকায় রাখা হবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন গত ২৫ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘শাপলা প্রতীক প্রথমে নাগরিক ঐক্য চেয়েছিল, তাদের দেওয়া হয়নি। পরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চেয়েছে, তাদেরও দেওয়া হয়নি। শাপলা প্রতীক কেন দেওয়া হবে না, তার ব্যাখ্যা দেবে না নির্বাচন কমিশন।’

ইএফ/